রিভিউঃ১
বইয়ের নামঃ যদ্যপি আমার গুরু
লেখকঃ আহমদ ছফা
“পড়ার কাজটি অইল অন্যরকম। আপনে যখন মনে
করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে
পারবেন কিনা। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো
শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল
জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইর্যা নিবেন , আপনের পড়া অয় নাই।”............... আব্দুর রাজ্জাক স্যার
আসলে সহজ
কথায় “যদ্যপি আমার গুরু” বইয়ের সারাংশ উপরের লাইন কয়টির মধ্যে নিহিত।আহমদ ছফার সাথে
আব্দুর রাজ্জাক স্যারের পরিচয় হয়েছিল বাংলা একাডেমীর বৃত্তিতে আহমদ ছফার “The growth of
middle class in Bengal as it influenced its literature, society and economics
from Eighteenth to Eighteen Fifty Eight”(অসমাপ্ত) টপিকের থিসিসে আনুফিসিয়াল সুপারভাইজার হিসেবে । তরুণ ছফা যখন বুঝতে পারছিলেননা কিভাবে শুরু করবেন তখন স্যার শব্দ করে হেসে তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজার হ্যারল্ড লাস্কির কাছ থেকে একই প্রশ্নের যে উত্তর পেয়েছিলেন তাই বললেন। লাইব্রেরি দেখিয়ে দিয়ে লাস্কি বলেছিলেন, “My boy,
go and soak!”আর এই “সোক” করার মানে হল,“প্রথম লাইব্রেরিতে ঢুইক্যাই
আপনার টপিকের কাছাকাছি যে যে বই পাওন যায় পয়লা
একচোটে পইড়া ফেলাইবেন। তারপর একটা সময় আইব আপনে নিজেই পাইবেন আপনের
আগাইবার পথ।” অবশ্য এই পথ খোঁজাই আহমদ ছফার
পিএইচডি শেষ করতে না পারার “কাল” হয়েছিল ।
ছফা আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে ছিলেন প্রায় সাতাশ বছর। সুদীর্ঘ একটা সময়। সম্পর্কে ছাত্র-শিক্ষক হলেও মনে হয়নি তাদের সম্পর্কটায় আদৌ কোন ফর্ম্যালিটি ছিল। এত দীর্ঘ সময় ধরে কাউকে গুনমুদ্ধ করে রাখা কিন্তু খুব কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আবদুর রাজ্জাক পেরেছিলেন, শুধু ছফা নয়, সমসাময়িক অনেক প্রতিভাবানেরাই তাকে গুরুর আসনে আসীন করেছেন। এই মানুষটিকে বিশ্বকোষ বললে বাড়িয়ে বলা হয় না, জ্ঞানের শাখায় শাখায় তার অবাধ বিচরণ। ছাত্রের মনের জানালা খুলে দেয়া শিক্ষক
বুঝে এমন কাউকেই বলে। অথচ বিস্তর পড়াশোনা, অগাধ জ্ঞানী এই মানুষটি কখনও নিজে
কিছু লেখেননি । আবদুর রাজ্জাক স্যার কেন লেখেননি এই ব্যাপারে ছফা
ব্যাখা দিয়েছেন এভাবে, এই মানুষটি তার সমকালীনদের গন্ডি পেরিয়ে এতখানিই উপরে
উঠেছিলেন যে তাদের কাতারে নেমে আসা হয়ত একটু মুশকিল হত তাঁর জন্য। আবদুর
রাজ্জাক স্যারকে সমালোচনাও কিন্তু তাকে কম শুনতে হয়নি। তৎকালীন বহু
বিখ্যাত ও বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিদের নাম উঠে এসেছে ভাল মন্দ নানা প্রসংগে।
উজ্জল একটি নক্ষত্রের মত এই মানুষটির ব্যক্তিজীবন ছিল খুব অদ্ভূত। খাঁটি
ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন, কাপড়-চোপড়ের নেই কোন আড়ম্বর, খেতেও ভালবাসেন যা কিছু
বাঙালী। অথচ তিনি কতটা বিশ্বজনীন প্রখর দৃষ্টির অধিকারী এই ব্যাপারে
ছফা মন্তব্য করেছেন, “নিজেস্ব সামাজিক অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে এবং নিজের সামাজিক পরিচিতির আদি
বৈশিষ্ট্যসমূহ গৌরবের সাথে ধারণ করে একটি বিশ্বদৃষ্টির অধিকারী হওয়া
চাট্টিখানি কথা নয়।”
বইটি অসংখ্য রেফারেন্স পেতে পারি । ইতিহাস, ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য এত এত বিষয় দুজনের
আলাপচারিতায় উঠে এসেছে যে কেউ যদি এসব বিষয়ে আরও পড়াশোনা করতে চান
তাহলে রেফারেন্স হিসাবে কি পড়বেন আমাদের আলোচ্য গুরুর কাছ থেকে তা ভালই জেনে
নিতে পারবেন। বাংলার সুলতান থেকে শুরু করে জিন্নাহ, বঙ্কিম থেকে শুরু করে টলস্টয়,
ভারতীয় শাস্ত্রীয়
সংগীত থেকে বিথোভেনের মুনলিট সোনাটা, মার্ক্স-এঙ্গেলস থেকে অ্যাডাম স্মিথ, ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র কিংবা
সেক্যুলারিজম সবই তাদের আলোচনায় একে একে উঠে এসেছে। এমন নয় যে আপনি এসব সম্পর্কে বিস্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ
পাবেন এ বইয়ে, কিন্তু জ্ঞানের
নানা শাখার সূত্র ধরিয়ে দিতে অবশ্যই সক্ষম হবে বলে আশা রাখছি।
এমনভাবেই তিনি মানুষের সাথে কথা বলতেন, কি বেঙ্গল সমাজের নেচার, কি হেনরি কিসিঞ্জার, শেখ মুজিব বা মাওলানা ভাসানীর নেচার- সকল বিষয়ে তার এরকম খুব সূক্ষ্ণ ও সংক্ষিপ্ত মতামত ছিল যা যেকোন যৌক্তিক মানুষকে ভাবাত উত্তর দেয়ার আগে। এই “naïve, simple, precise and straight forward” ব্যাপারটা বিশেষভাবে আকর্ষণীয় । জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে চলমান বিশ্বকোষ বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হয় না।জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে চলমান বিশ্বকোষ বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হয় না।বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠসমূহের শ্রেষ্ঠ মনিষীদের অনেকেই একবাক্যে তাঁর মেধা এবং ধীশক্তির অনন্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। এই মানুষটি তাঁর মেধা এবং মননশক্তি দিয়ে জাতীয় জীবনের সন্ধিক্ষণ এবং সংকটময় মুহূর্তসময়ে পথনির্দেশ করেছেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, বলতে গেলে, চারটি দশক ধরেই তরুন বিদ্যার্থীদের এই নিভৃতচারী, অনাড়ম্বর জ্ঞানসাধক মানুষটি সারা জীবন কোনো বই রচনা করেননি। সভা-সমিতিতে কথাবার্তা বলারও বিশেষ অভ্যাস তাঁর নেই। তথাপি কৃশকায়, অকৃতদার অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন।
সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একজন প্রবাদতুল্য পুরুষ । কিন্তু তাঁর জ্ঞানচর্চার পরিধি কতদূর বিস্তৃত, আর তিনি ব্যক্তি মানুষটি কেমন সে বিষয়েও মুষ্টিমেয় ক'জনের বাইরে খুব বেশি মানুষের সম্যক ধারণা নেই। যদ্যপি আমার গুরু বইটি পাঠক-সাধারণের মনে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মনীষা এবং মানুষ আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কে একটি ধারণা গঠন করতে অনেকখানি সাহায্য করবে।
এমনভাবেই তিনি মানুষের সাথে কথা বলতেন, কি বেঙ্গল সমাজের নেচার, কি হেনরি কিসিঞ্জার, শেখ মুজিব বা মাওলানা ভাসানীর নেচার- সকল বিষয়ে তার এরকম খুব সূক্ষ্ণ ও সংক্ষিপ্ত মতামত ছিল যা যেকোন যৌক্তিক মানুষকে ভাবাত উত্তর দেয়ার আগে। এই “naïve, simple, precise and straight forward” ব্যাপারটা বিশেষভাবে আকর্ষণীয় । জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে চলমান বিশ্বকোষ বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হয় না।জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে চলমান বিশ্বকোষ বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হয় না।বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠসমূহের শ্রেষ্ঠ মনিষীদের অনেকেই একবাক্যে তাঁর মেধা এবং ধীশক্তির অনন্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। এই মানুষটি তাঁর মেধা এবং মননশক্তি দিয়ে জাতীয় জীবনের সন্ধিক্ষণ এবং সংকটময় মুহূর্তসময়ে পথনির্দেশ করেছেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, বলতে গেলে, চারটি দশক ধরেই তরুন বিদ্যার্থীদের এই নিভৃতচারী, অনাড়ম্বর জ্ঞানসাধক মানুষটি সারা জীবন কোনো বই রচনা করেননি। সভা-সমিতিতে কথাবার্তা বলারও বিশেষ অভ্যাস তাঁর নেই। তথাপি কৃশকায়, অকৃতদার অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন।
সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একজন প্রবাদতুল্য পুরুষ । কিন্তু তাঁর জ্ঞানচর্চার পরিধি কতদূর বিস্তৃত, আর তিনি ব্যক্তি মানুষটি কেমন সে বিষয়েও মুষ্টিমেয় ক'জনের বাইরে খুব বেশি মানুষের সম্যক ধারণা নেই। যদ্যপি আমার গুরু বইটি পাঠক-সাধারণের মনে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মনীষা এবং মানুষ আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কে একটি ধারণা গঠন করতে অনেকখানি সাহায্য করবে।
বিজয় একাত্তর হল,ঢাঃবিঃ
No comments:
Post a Comment