যান্ত্রিক শহর থেকে প্রকৃতির রাজ্যে
টিএসসি থেকে যাত্রা আরম্ভ করলাম আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপের রোভাররা। গন্তব্য গাজীপুর সাফারি পার্ক, ভাওয়াল উদ্যান ও রোভার পল্লী। ঢাকা থেকে গাজীপুর সাফারি পার্ক মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার দূরে।তাই বেলা ১১ টায় পৌঁছে গেলাম।
সাফারি কিংডম, গাজীপুর সাফারি পার্ক। |
প্রবেশ করতেই ডান পাশে আছে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ম্যাপ। মূলত সাফারি পার্কটি ৫টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। ১. কোর সাফারি। ২. সাফারি কিংডম। ৩. বায়োডাইভার্সিটি পার্ক। ৪. এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারি পার্ক। ৫. বঙ্গবন্ধু স্কয়ার।
প্রথমেই প্রবেশ করলাম সাফারি কিংডমে। ৫৫৬ একরের ওপরে তৈরি করা এই অংশে ঢুকতেই চোখে পড়ল নজরকাড়া ম্যাকাওল্যান্ড। এখানে আরও আছে নীল-সোনালি ম্যাকাও, সবুজ ম্যাকাও, টিয়া, আফ্রিকান গ্রে-প্যারট, পেলিক্যান, লুটিনো রিংনেক প্যারটসহ প্রায় ৩৪ প্রজাতির পাখি, রয়েছে প্রায় ২০ প্রজাতির মাছ। ক্রোকোডাইল ফিশ, টাইগার ফিশ ও অস্কার। রয়েছে চিকলেট মাছ যা ২০ সেকেন্ড পর পর রং পরিবর্তন করে।
এরপর দেখলাম প্রজাপতি সাফারি। যেখানে প্রায় ২৬ প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। সাফারি কিংডমের একটি অংশে আলাদাভাবে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল তিনটি পাখিশালা। ধনেশ পাখিশালায় রয়েছে প্রায় আট প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির প্যারট, পিজেন্ট ধনেশ, ফ্লেমিঙ্গো, কালো সোয়ান ও বিরল প্রজাতির ম্যান্ডারিন ডাক। বাংলাদেশের মিনি আফ্রিকার সৌন্দর্য তরুণ রোভারদের বিমোহিত করেছে, রেখে দিয়েছে অতৃপ্ততা।
আরো আছে কোর সাফারি পার্ক । এখানে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে দুটি জিপ ও দুটি মিনিবাস। মিনিবাসে চড়ে খুব কাছ থেকে দেখলাম প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেড়ে রাখা বাঘ, সিংহ, কালো ভালুক, আফ্রিকান চিতা, চিত্রা হরিণ, সাম্বার ও গয়াল, হাতি, মায়া ও প্যারা হরিণ।
আমাদের আরো দুই জায়গায় যেতে হবে তাই বাংলাদেশের মিনি আফ্রিকাকে অনিচ্ছার শর্তেও বিদায় জানাতে হল। আমরা রোভার পল্লীতে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েই রওনা হলাম ভাওয়াল উদ্যানের পথে, প্রকৃতির টানে।
ভাওয়াল উদ্যানের শাল বৃক্ষের মাঝে ফুলের চাষ। |
ভাওয়াল উদ্যানের পথ।। |
বেলা ৩ঃ৩০ মিনিটের দিকে প্রবেশ করলাম সবুজের রাজ্যে। বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস নেয়ার অফুরন্ত সুযোগ। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের মূল উদ্ভিদ হলো শাল। প্রায় ২২০ প্রজাতির গাছপালা আছে এ বনে। এর মধ্যে ৪৩ প্রজাতির বিভিন্ন রকম গাছ, ১৯ প্রজাতির গুল্ম, ৩ প্রজাতির পাম, ২৭ প্রজাতির ঘাস, ২৪ প্রজাতির লতা, ১০৪ প্রজাতির ঔষধি গাছ। গাছের সারির মাঝে পায়ে চলার পথ। মাঝে মাঝে আছে বসার ব্যবস্থা। হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।খুবই তৃষ্ণার্ত ছিলাম। পানি পাচ্ছিলাম না । পরে অবশ্য এক ইজি-বাইক চালক আমাদের পানির সন্ধান দিয়েছিলেন। আমি পথ দিয়ে হাঁটছিলাম এর ছবি তুলছিলাম । উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম আমি ভাওয়ালের ভয়ংকর সৌন্দার্যে। ঘন গাছ গাছালি মাঝে আঁকা-বাঁকা পথ, কখনো ফাঁকা মাঠ, বিল, আবার কখনোবা ছোট ছোট পুকুর। মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে পাখির কিচির-মিচির আওয়াজ।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে ভাওয়াল উদ্যান। |
বক, দোয়েল, হটটিটি, মাছরাঙা, কুরা ঈগল, হাড়ি চাচা, বেনে বৌ, বুলবুল, নীলকন্ঠ, শালিক, চড়ুই, ভাত শালিক ইত্যাদি পাখিগুলো দেখে আমি ফিরে গিয়েছিলাম জসীম উদদীনের পল্লী গাঁয়। নির্জন বনের মধ্যে হাঁটার সময় নানারকম পাখির কিচির-মিচির ডাকে আমি এক ধরনের অপার্থিব অনুভূতির স্বাদ আস্বাদন করেছি যা এ যান্ত্রিক শহর আমায় দিতে পারেনি।
ফেরার পথে আমি প্রস্তাব করলাম শাল বনের মাঝ দিয়ে হাঁটার। সাথে ছিল বন্ধু ফুয়াদ, জাকারিয়া ভাই, মুস্তাফিজ ভাই, ফেরদাউস ভাই আরো অনেকে। শাল বনের মাঝে কাঁটা যুক্ত এক ধরণের গুল্ম বৃক্ষ ছিল যা আমাদের পথ চলাকে বেশ কঠিন করে তুলেছিল। কিন্তু পায়ের নিচে শুকনা পাতার মর্মর আওয়াজে এক ধরনের নৈস্বর্গিক আনন্দ লাভ করেছি। শাল বনের মধ্যে লাল রঙের এক ধরনেত্র ফুলের চাষ করা হয়েছে। যা শাল বনের সৌন্দার্যকে শত গুনে বৃদ্ধি করেছে।
ওয়াচ টাওয়ার |
পুরো উদ্যান এক নজরে দেখার জন্য রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার।ওয়াচ টাওয়ারে উঠে দেখলাম ভাওয়ালের ভয়ংকার সৌন্দার্য।মনে হচ্ছিল কোন শিল্পীর তুলিতে আঁকা সবুজ রাজ্য।কিছু ছবি তুলে নিলাম ওয়াচ টাওয়ারের চূড়া থেকে। নেমেই ডান হাতে আছে একটি মনোরম শিশু পার্ক।শিশু পার্কে ঢুকে একটু বাচ্চামি করলাম। বের হওয়ার সময় আপেলের বিচি দিয়ে তৈরি মালা কিনলাম আমরা তিন জন (জাকারিয়া ভাই, ফুয়াদ এবং আমি)।
ভাওয়াল উদ্যান ঘুরে দেখার মুহূর্ত। |
No comments:
Post a Comment