চদ্রনাথ জয়
ক্লাস, আস্যাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন আর পরীক্ষার চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে একটি দিন কাটানোর জন্যে সীতাকুণ্ডে ভ্রমনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই আমরা বিজয় একাত্তর হলের সমসজবিজ্ঞান বিভাগের সিক্ষার্থীরা। যেই কথা সেই কাজ ১১ তারিখ সন্ধ্যায় একযোগে আমরা ৪০ জন রওনা হলাম। কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে রাত ১০ টার ট্রেনে যাত্রা শুরু করলাম । সকাল ৮ টার দিকে সীতাকুণ্ড রেল স্টেশনে পৌঁছলাম । ওখানেই নাস্তা করে ব্যাটারী চালিত বাইকে রওনা হলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়েহয়র পথে। চন্দ্রনাথ পাহাড় এখান থেকে বেশি দূরে নয় । শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে। এদুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মনে হলো যেন মন্দিরের শহরে বিচরণ করছি। হ্যাঁ, সত্যিই তাই সীতাকুণ্ডকে মন্দিরের শহর বলা হয়। রাস্তার দুই দিকেই রাস্তার দুই পাশেই নতুন পুরাতন অনেক মন্দির আছে। বাইক চালকের কথা শুনে তো আমি আরো অবাক হলাম! বললেন, এই সীতাকুণ্ডে প্রায় আড়াইশোর বেশি মন্দির আছে।
আমাদের ব্যাগ গুলো হেফাজতে রেখে দিলাম ওখানকার একটি দোকানে বিশ টাকার বিনিময়। পাহাড়ে ওঠার সুবিধার্থে লাঠি নিয়ে নিলাম। পাহাড়ে অঠার জন্য সুবিধাজনক পোশাক পরে নিলাম । পিঠে ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে লাঠি হাতে , দৃঢ় পদে অগ্রসর হলাম চন্দ্রনাথ জয়ের নেশায়।শুরুতেই সবাই একসাথে একটা ছুবি তুললাম। একটুখানি ওপরে উঠতেই চোখে পড়ল মস্ত বড় পাহাড়। কি সুন্দর দেখতে! সবুজে মুড়ানো। দেখে পরান জুড়িয়ে গেল। নিচ থেকে দেখেই চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সৌন্দার্যের প্রেমে পরে গেলেম। আগ্রহ বেড়ে দ্বিগুণ হল। ইতিমধ্যেই আমরা কয়েক জন বন্ধু ছবি তোলার কারণে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আরো ২ মিনিট এগিয়ে একটি টং দোকান সবাইকে পেলাম । সেখান থেকে স্যালাইন পানি কিনে নিলাম । পাহাড়ের মাঝে মাঝেই বিশ্রাম নেয়ার জন্য এবং হাল্কা কিছু খাওয়ার জন্য এমন দোকান আছে। এখানে বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম আমরা।
প্রথমদিকে তেমন কষ্ট না হলেও তিনশো ফুট থেকে ভ্রমণকারীকে উঠতে হবে খাড়া পাহাড় বেয়ে।বিপদ এখানেই শেষ নয় কখনো কখনো চলতে হবে এক পাশে পাহাড়ের গা ঘেঁষে আর অন্য পাশে খাদ নিয়ে। একবার পা ফসকালেই পড়তে হবে ৩০০-৪০০ ফুট নিচে। মাঝে মাঝে এই পথ এতটাই সরু যে, দুজন মানুষ একসঙ্গে উঠা-নামা করা প্রায় অসম্ভব। চলতে গিয়ে প্রাচীনকালের তৈরি কিছু সিঁড়িও পাবেন। কে কত সালে সে সিঁড়ি কেন বানিয়েছেন সাথে আছে তার নামফলকও। এগুলো কিছু ছবিও তুলে রেখেছি আমি। চারদিকে নিরব-নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে শুনতে পাবেন চেনা-অচেনা পাখির ডাক। দেখতে পাবেন ঝরনাও।আবার মাঝে মাঝে পাবেন ফলের গাছও। কখনো ইটের সিঁড়ি আবার কখনো মাটি কেটে তৈরি করা হইয়েছে সিঁড়ি।
প্রায় ঘন্টা দেড় পর ক্লান্ত শরীরে আমরা পৌঁছলাম প্রথম পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে রয়েছে শ্রী শ্রী বিরূপাক্ষ মন্দির।দোকান থেকে পূজার উপাদান ক্রয় করে পূজা দিচ্ছেন হিন্দু ধর্ম্বালম্বীরা। এটা তাদের শিব দেবতার বাড়ি। প্রতিবছর এই মন্দিরে শিবরাত্রি তথা শিবর্তুদশী তিথিতে বিশেষ পূজা হয়। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডে বিশাল মেলা হয়। সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড় এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর বাংলা ফাল্গুন মাসে (ইংরেজী ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস) বড় ধরনের একটি মেলার আয়োজন করে থাকেন। যেটি শিবর্তুদর্শী মেলা নামে পরিচিত। এই মেলায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য সাধু এবং নারী-পুরুষ যোগদান করেন।
এখানে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে রওনা হলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দিকে। সেখানেও একটা মন্দির আছে , চন্দ্রনাথ মন্দির। বিরূপাক্ষ মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ মন্দিরের ১৫০ ফুট রাস্তার প্রায় ১০০ ফুটই উঠতে হবে খাড়া পাহাড় বেয়ে এটা শুনে আরো বেশি ক্লান্ত হয়ে গেলাম । সেখানে নিজেকে সামলে রাখা অনেকটাই কষ্টকর।এই ১৫০ ফুট রাস্তায় বার বার বিশ্রাম নিতে হয়েছে। মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে পড়ি চদ্রনাথ পাহাড়ের সিঁড়িতে। অবশেষে খাড়া পাহাড় বেয়ে মাটি থেকে ১২০০ ফুট উপরে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠলাম আমরা ( মনির , হাদি, জুবায়ের এবং আমি)।চন্দ্রনাথ মন্দিরের বারান্দায় বসে খোশ গল্প করছিল আন্যরা । যোগ দিলাম সবার সাথে।সীতাকুণ্ডের সর্বোচ্চ উঁচু পাহাড় চন্দ্রনাথের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা। এখান থেকেই অবলোকন করা যায় দু’পাশের অপরূপ সুন্দর প্রকৃতি। একদিকে সমুদ্র আর অন্য দিকে পাহাড়ের নির্জনতা। ডানদিকে তাকালে মনে হয় সম্পূর্ণ অঞ্চলটাই সবুজ কার্পেট দিয়ে মুড়ানো। আবার বাঁ দিকে তাকাতেই ধরা পড়ে অফুরন্ত জলরাশি। এজন্যই চন্দ্রনাথ পাহাড় অয়াডভাঞ্চারপ্রিয় এবং প্রকৃতিপ্রেমী উভয় ভ্রমণকারীরই মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে।
বিশ্রাম শেষে আমরা আবারো একসাথে ছবি তুললাম । রাশেদ ভাই এবং আঃ রহিম ভাইয়ের নেতৃত্বে নামতে আরম্ভ করলাম । চন্দ্রনাথ মন্দিরের পাশের এই পথ পুরোটাই পাকা সিঁড়ি করা কিন্তু খাড়া। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হল বিরূপাক্ষ মন্দিরের রাস্তা দিয়ে ওঠা এর চন্দ্রনাথ মন্দিরের রাস্তা দিয়ে নামা। অনেককেই দেখেছি এর উল্টোটা করতে। আমরা ভুল করি নি কারণ আমাদের সাথে অভিজ্ঞ লোক ছিল যে আগেও এপর্বতে চড়েছে। নামার পথে দুই পাহাড়ের মিলনস্থলে একটি সুড়ঙ্গ পথ আছে এখানে সারাক্ষণই ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহিত হয়। সুড়ঙ্গে প্রবেশের পর কিছুটা ক্লান্তি দূর হল। নামার পর আরেকটি মন্দির পেলাম যেখানে ঐতিহ্যবাহী শ্যামা সঙ্গীত পরিবেশিত হচ্ছিল। ২৬-২৭ বছর বয়সী একজন শিল্পী গান করছিলেন । তন্ময় হয়ে তার মিষ্টি কণ্ঠের গান শুনছিলাম । স্মৃতি রক্ষার্থে ভিডিও করতে ভুলিনি। চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে বের হলাম। পাশের একটি পুকুরে গোসল করে নিলাম । অথিতি রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম । তারপর বিদায় জানালাম মন্দিরের শহরকে।